আমরা অনেকেই নিজেকে পরিবর্তন করতে চাই। নিজের বদঅভ্যাসগুলো পরির্তন করে ভাল ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু কেন যেন কাজটা ঠিকঠাকভাবে করে উঠতে পারি না। অভ্যাস বদলানোর চেষ্টা শুরু করলেও দেখা যায় দুইদিন যেতে না যেতেই আমরা আবার বদঅভ্যাসে ডুবে যাই। অভ্যাস পরিবর্তন করা আর হয়ে ওঠে না। নিজেদের পুরোনো অভ্যাসের শিকলে আমরা বাঁধা পড়ে যাই।
আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার লেখক জেমস ক্লিয়ার তাঁর লেখা ‘অ্যাটমিক হ্যাবিটস’ বইয়ে সহজে অভ্যাস পরিবর্তন করার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। চলুন, অ্যাটমিক হ্যাবিটস বইয়ের আলোকে অভ্যাস পরিবর্তন করার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
অভ্যাস পরিবর্তনের গুরুত্ব
অনেকের ধারণা সফল ব্যক্তিগণ স্রেফ পরিশ্রম, মেধা, প্রতিভা কিংবা সৌভাগ্যের জোরে সফলতা পেয়েছেন। কিন্তু একটা বিষয় সবার চোখ এড়িয়ে যায়, তা হলো- অভ্যাস।
আপনার যতই প্রতিভা থাকুক, মেধা থাকুক কিংবা আপনি যতই সৌভাগ্যবান হোন না কেন, আপনার অভ্যাস যদি ভাল না হয়, আপনি যদি বদঅভ্যাসে ডুবে থাকেন আপনার পক্ষে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব হবে না। তাই সফল হতে অভ্যাস পরিবর্তন করা আবশ্যক। বদঅভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করে, ভাল অভ্যাস আয়ত্ব করার কোনো বিকল্প নেই।
ক. ছোট ছোট অভ্যাসের অবিশ্বাস্য শক্তি
নতুন অভ্যাস চর্চার শুরুতে দৃশ্যমান কোনো ফল না পাওয়া গেলেও কয়েকটি ছোট ছোট অভ্যাস গড়ে তুললে, সেগুলোর সম্মিলনে চমৎকার ফল পাওয়া যায়। ছোট অভ্যাসগুলো নিয়মিত ধরে রাখলে মানুষ প্রতিদিন আগের চেয়ে ভাল, দক্ষ, গোছানো হতে থাকে।
সাধারণত ৩ মাস, ৬ মাস বা ১ বছর পর পার্থক্যটা চোখে পড়ে। মনে রাখতে হবে, রাতারাতি কোনোকিছু বদলে যাবে না। অভ্যাস বদলানোর পর ফল আসতে কিছুটা সময় লাগবে।
“A slight change in your daily habits can guide your life to a very different destination.”
খ. লক্ষ্য নয়, অভ্যাস বদলান
নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে হ্যাবিট সিস্টেম বা অভ্যাস পদ্ধতির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে আপনার দৃষ্টিসীমা ছোট হয়ে যাবে। কোনোভাবে লক্ষ্যে পৌঁছে গেলে আপনি আবার দিশেহারা বোধ করবেন। লক্ষ্য অর্জন করা একটি সাময়িক বিষয়, কিন্তু অভ্যাস চিরজীবনের জন্য।
অনেক সফল ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরও একটা পর্যায়ে গিয়ে হতাশা ও ডিপ্রেশনে ভুগতে দেখা যায়। এত অর্থবিত্ত থাকার পরেও তাদের এই হতাশার একটি অন্যতম কারণ হলো লক্ষ্য পূরণ হয়ে যাওয়া এবং দিশেহারা বোধ করা। এত কিছু পেয়ে যাওয়ার পর তারা এবার কী করবেন তা আর খুঁজে পান না বা বুঝে উঠতে পারেন না। এজন্য কার্যকরী অভ্যাসের চর্চা করা উচিত।
“Success is the product of daily habits- not once-in-a lifetime transformations.”
গ. উইনার আর লুজারের লক্ষ্য একই
খেয়াল করে দেখবেন- উইনার ও লুজার; এইদুই ধরনের মানুষের কিন্তু লক্ষ্য অনেকটা একই। দুইধরনের মানুষই জীবনে সফল হতে চায়, সুখী হতে চায়। কিন্তু তারপরেও একধরনের মানুষ উইনার তথা বিজয়ী হয়, আর অন্যধরনের মানুষ লুজার তথা ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণ : অভ্যাস। একই লক্ষ্য থাকার পরেও ভাল অভ্যাস রপ্ত না করার কারণে একজন মানুষ লুজার হতে পারে।
ধরা যাক, আপনার রুমটা নোংরা হয়ে আছে। রুমটা পরিস্কার করে গুছিয়ে রাখার লক্ষ্য ঠিক করলেন। সেই মোতাবেক একদিন রুমটা পরিস্কার করে ফেললেন। কিন্তু দুই দিন যেতে না যেতেই দেখলেন, আপনার রুমটা আবার আগের মতো নোংরা হয়ে গেছে। কারণ আপনি নিজের অভ্যাসের দিকে মনোযোগ দেননি।
আপনার কোন কোন অভ্যাস বা বদঅভ্যাসের কারণে রুম নোংরা হয় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি ছিল। এক এক করে সেই অভ্যাসগুলো বদলে নেওয়ার মাধ্যমে আপনি রুম নোংরা হওয়া ঠেকাতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে নোংরা রুম পরিস্কার করার সাময়িক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। তাই রুমটা আবার দ্রুত নোংরা হয়ে গেছে।
“Forget about goals, focus on the system instead.”
তাই লেখক জেমস ক্লিয়ার এটমিক হ্যাবিট বইয়ে লক্ষ্যের চেয়ে অভ্যাসের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে বলেছেন। লক্ষ্য পৌঁছে গেলে মানুষ খুশি হয়। কিন্তু তারপর? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পর মানুষ হাল ছেড়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে আবার ব্যর্থ জীবনে পর্যবসিত হয়। কারণ ভাল অভ্যাস তার রপ্ত করা ছিল না। সে শুধু একটি লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছে মাত্র। লক্ষ্য বা টার্গেট পূরণ করার চেষ্টা করলে জীবনে স্থিরতা আসবে না। সেজন্য প্রয়োজন চমৎকার সব অভ্যাস।
ঘ. অভ্যাস আপনার পরিচয় তৈরি করে
মানুষ অভ্যাসের দাস- কথাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই? মানুষ তার জীবনে তিন ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
- ফলাফল ভিত্তিক পরিবর্তন
- প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিগত পরিবর্তন
- পরিচয়গত পরিবর্তন
কিন্তু সবচেয়ে কার্যকরী পরিবর্তন হলো পরিচয়গত পরিবর্তন। প্রথমে ঠিক করুন আপনি কোনধরনের ব্যক্তি হয়ে উঠতে চান। তারপর ছোট ছোট কাজ করে নিজের কাছে তা প্রমাণ করুন যে আপনি সত্যি সত্যি সেই ব্যক্তিটি হয়ে উঠছেন।
কীভাবে?
ধরা যাক, আপনি নিয়মিত বই পড়তে চান, একজন পাঠক হয়ে উঠতে চান। কিন্তু আপনার বই পড়ার অভ্যাস নেই। সেক্ষেত্রে আপনি যদি একটা বই পড়ে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থ হতে পারেন। কারণ দেখা যাবে, কোনোমতে একটা বই পড়ে শেষ করেছেন ঠিকই কিন্তু তারপর আর কোনো বই পড়া হয়ে উঠছে না। কিন্তু পাঠক বা বইপড়ুয়ার পরিচয়টিকে যদি নিজের ব্যক্তিত্বের অংশ করে নেন তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এবার ভাবুন, আপনি একজন বইপড়ুয়া। নিজেকে প্রশ্ন করুন একজন বইপড়ুয়ার কাজ কী? বই পড়া। তাহলে আপনার কাজ কী? বই পড়া।
কিন্তু আপনি তো বই পড়ে অভ্যস্ত নন, তাহলে উপায়?
প্রতিদিন অন্তত এক পৃষ্ঠা করে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বই পড়াটাকে নিজের পরিচয়ের অংশ বানিয়ে নিন। এভাবে ধীরে ধীরে প্রতিদিন বই পড়ার পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়িয়ে একপর্যায়ে আপনি একজন নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠতে পারবেন।
“Just as atoms are the building blocks of molecules, atomic habits are the building blocks of remarkable results.”
অভ্যাস বদলানোর ৪টি উপায়
অভ্যাস এমন একধরনের আচরণ যা ইতোমধ্যে এতবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যে একটা পর্যায়ে গিয়ে তা অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়। কোনো একটি কাজ অভ্যাসে পরিণত হলে সেই কাজ করতে কোনো বাড়তি চেষ্টা বা জোর খাটাতে হয় না।
তাহলে যে খারাপ অভ্যাসটি আমাদের দেহে, মনে সেঁটে বসে আছে তা বদলানোর উপায় কী?
লেখক জেমস ক্লিয়ারের মতে, চারটি উপায় আছে-
উপায় ১. নতুন অভ্যাসের বিষয়টি সহজ করে তুলুন
ধরা যাক, আপনি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে হাতের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রাখুন। যেমন : সবজির ঝুড়ি, প্রয়োজনী বাটি, সবজি কাটা বা ছিলার উপকরণ ইত্যাদি হাতের কাছে রাখুন। যেন প্রয়োজনের সময় সহজেই জিনিসগুলো হাতে কাছে পেয়ে যান। এতে আপনার অভ্যাসটি চর্চা করতে সুবিধা হবে।
মনে রাখবেন, ভাল অভ্যাস তৈরি বা চর্চা করার বিষয়টি আপনি নিজের জন্য যত সহজ করে সাজিয়ে রাখবেন আপনার জন্য তত সুবিধা হবে। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন –
ক. অভ্যাস বদলানোর আগে অভ্যাস চিহ্নিত করে নিন
অভ্যাস বদলাতে চাচ্ছেন মানে আপনার জীবনের কিছু একটা ঠিক চলছে না। কোথাও নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে কিংবা বা কোনো বিষয়ে আপনি অসন্তুষ্ট। তাই সবার আগে নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন করুন। কোন কাজ, কখন করবেন। কোন কাজটা আপনি বদলাতে চান। সেগুলো চিহ্নিত করে নিন।
নতুন অভ্যাস শুরু করার ক্ষেত্রে সময় আর স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূত্রটি এরকম :
আমি অমুক কাজটি করব (যা করতে চান) + ঠিক কয়টার সময় করব (যখন করবেন) + যেখানে করব (কাজ করার স্থান)
ধরা যাক, আপনি বাসার ছাদে গিয়ে সকাল ৬ টায় ব্যায়াম করতে চান। সেক্ষেত্রে সময়, স্থান, কাজ সব ঠিক করে নিন। যেন আপনি নিজের কাছে আর কোনো অজুহাত দিতে না পারেন। অভ্যাস রপ্ত করার ক্ষেত্রে সবকিছু আগে থেকে স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন। এতে অভ্যাস রপ্ত করতে সুবিধা হয়।
খ. অভ্যাসের মালা গাঁথা
একটা ভাল অভ্যাস ধরার পর সেটার সাথে আরেকটা নতুন ভাল অভ্যাস জুড়ে দিন। যেন আপনি পর্যায়ক্রমে আরো ভাল ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন। এভাবে ভাবুন, প্রথমে এই অভ্যাস করার পর, আমি এই অভ্যাসটা রপ্ত করে ফেলব।
যেমন : রাতে দাঁত ব্রাশ করার পর আমি ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলব। সকাল ৭টার ভেতরে নাস্তা সেরে আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে অফিসে যাব। ইত্যাদি।
“Your identity emerges out of your habits.”
গ. আত্মনিয়ন্ত্রণ করার গোপনসূত্র
বদঅভ্যাসের সাথে আত্মনিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। সেজন্য খারাপ জিনিসকে অদৃশ্য করে দেওয়া জরুরি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান সৈনিকরা সহজে হিরোইন পেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। কিন্তু সৈনিকদের সেখান থেকে সরিয়ে যখন এমন জায়গায় নেওয়া হলো যেখানে আর হিরোইন পাওয়া যায় না; তখন প্রতি ১০ জনের ৯ জন সৈনিক হিরোইনের বাজে নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিল।
এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, নেশা এবং বদঅভ্যাস দূর করা সম্ভব যদি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। অনেকে বলে থাকে, ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। কিন্তু সেটা শুধুই আবেগের কথা। বাস্তবতা ভিন্ন। শুধু ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট নয়, সেই সাথে উপযুক্ত পরিবেশও প্রয়োজন।
“Bad habits can cut you down just as easily as good habits can build you up.”
আপনি যদি পর্ণ দেখা বন্ধ করতে চান তাহলে ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামের নগ্ন, অর্ধনগ্ন, আবেদনমীয় মডেলদের ফলো করা বন্ধ করুন। তাদের যৌন উত্তেজক ছবি দেখার পর আপনার মনে পর্ণ দেখার চাহিদা তৈরি হতে পারে। এভাবে আপনি নিজের বিভিন্ন বদঅভ্যাসকে দমন করে আত্মনিয়ন্ত্রণে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবেন।
উপায় ২. অভ্যাস বদলানোকে আকর্ষণীয় করে তুলুন
অভ্যাসের সাথে আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন রিলিজের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
কিন্তু ডোপামিন কী?
ডোপামিন হলো একধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া বিশেষ বস্তু। আমরা যখন আনন্দিত হই তখন আমাদের মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন রিলিজ হয়। আমরা মনের অজান্তেই সেই কাজ করতে আগ্রহবোধ করি যা করলে বেশি বেশি ডোপামিন রিলিজ হয়। যে কাজ আমাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়, আমরা সেটা বারবার করতে চাই; এভাবে ডোপামিন রিলিজ আমাদেরকে বিভিন্ন কাজে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
তাই নতুন অভ্যাসকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে নিম্নের ট্রিকসগুলো অনুসরণ করুন –
ক. চোখের সামনে রাখুন
ধরা যাক, আপনি ফাস্ট ফুড খাওয়ার বদঅভ্যাস বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চাচ্ছেন, ওজন কমাতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে হাতে কাছে, ফ্রিজে টাটকা ফলমূল, সবজি রাখুন। যেন ফ্রিজ খুললেই আপনার সেসব দেখে চোখটা জুড়িয়ে যায় এবং আপনার ভেতরে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার স্পৃহা জেগে ওঠে।
“Environment is the invisible hand that shapes human behavior.”
খ. পরিবার ও বন্ধুদের ভূমিকা
আমরা তিন ধরনের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হই। প্রথমে আমাদের পরিবার। তারপর বন্ধু। তারপর আমাদের সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। যে আচরণ করলে লোকে সম্মান করে, প্রশংসা করে, যে আচরণ করে ফায়দা মেলে আমাদের কাছে সেই আচরণকে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।
ভাল অভ্যাস রপ্ত করতে চাইলে আপনাকে কৌশলী হতে হবে। যেমন :
- আপনার কাঙ্খিত অভ্যাস যাদের কাছে সাধারণ অভ্যাসের মতো, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করুন।
- এমন গ্রুপ বা দলের সাথে চলুন যাদের সাথে আপনার ভাবনার মিল আছে।
গ. বদঅভ্যাসের শিকড় অনুসন্ধান ও সমাধান
নিজের বদঅভ্যাসকে কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করুন। কারণ অভ্যাসকে যখন পজেটিভ অনুভূতির সাথে সংযুক্ত করা হয় তখন তা আমাদের কাছে ভাল মনে হয়, আকর্ষণীয় মনে হয়। কিন্তু নেগেটিভ অনুভূতির সাথে যুক্ত করা হলে তখন অনাকর্ষণীয় লাগে, ঘৃণা জাগে।
ধরা যাক, আপনি সিগারেট ছাড়তে চাচ্ছেন, তাহলে সিগারেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বেশি বেশি পড়ুন। ভিডিও দেখুন। এতে সিগারেটের ব্যাপারে ধীরে ধীরে আপনার মনে বিতৃষ্ণা জন্ম নেবে, আপনি নিজের সুস্থতার ব্যাপারে আরো সচেতন হয়ে উঠবেন।
উপায় ৩. সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করে রাখুন
আমরা খারাপ অভ্যাস বদলাতে চাই কিন্তু কাজে নামলে দেখা যায় ভাল অভ্যাস চর্চা করার পথে পদে পদে বাধা সৃষ্টি হয়ে আছে। তখন আমাদের আলসেমি পেয়ে বসে। আমরা পুনরায় খারাপ অভ্যাসেই নিজেদের শরীর এলিয়ে দিই। এটা রুখতে আমাদেরকে অবশ্য নতুন অভ্যাসের অনুকূলে সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করে রাখতে হবে।
যদি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়তে চাই সেক্ষেত্রে অবশ্যই রান্নাঘর পরিস্কার রাখতে হবে। যেন রান্না করতে গেলে মনটা চনমনে থাকে। স্বাস্থ্যকর রান্না করতে আগ্রহ জাগে। যদি রান্নাঘর পরিস্কার না থাকে তখন দেখা যাবে আর রান্না করতেই মন চাইবে না। তারচেয়ে বরং বাইরে থেকে ফাস্টফুড অর্ডার দিয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিতে ইচ্ছে করবে।
“Until you make the unconscious conscious, it will direct your life and you will call it fate.”
ক. ধীরে এগোন কিন্তু কখনো উল্টো দিকে ফিরে যাবেন না
শুরুতে একটা নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সেটা শারীরিক/মানসিক পরিশ্রম করতে হয়। তাই লেগে থাকার বিকল্প নেই।
প্রথম প্রথম গাড়ি চালানো শিখতে গেলে দেখবেন আপনার মাথায় অনেক চাপ পড়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে গাড়ির দূরত্ব ঠিক রাখা, গিয়ার চেঞ্জ করা, ক্লাচে চাপ দেওয়া, ব্রেক করা, গতি বাড়ানো, ট্রাফিক আইন মানা সহ কত জিনিস! তাই বলে গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে তো হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
“If you can get 1% better each day for one year, you’ll end up 37 times better by the time you’re done.”
একবার অভ্যস্ত হওয়ার পর ওই কাজগুলো আপনাকে আর অত হিসেব করে করতে হবে না। তখন আপনার শরীর, মস্তিত্ব সবকিছু অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে শিখে যায়। আপনি দিব্যি রিল্যাক্স থাকা অবস্থায় গাড়ি চালাতে পারেন।
তাই ভাল অভ্যাস রপ্ত করতে গিয়ে ভুল করেও আবার বদঅভ্যাসে জড়িয়ে পড়া চলবে না। প্রয়োজনে ধীরে এগোতে হবে।
উপায় ৪. নিজেকে পুরস্কৃত করুন
ভাল অভ্যাস তৈরি করা মানে বোরিং বা নিরানন্দ সময় কাটানো নয়। স্বাস্থ্যকর খাবারে পছন্দের সবজি, সস, ইত্যাদি ব্যবহার করুন। যেন খাবারটা উপভোগ করতে পারেন।
কাজের সাথে নিজের পছন্দের কিছুকে যুক্ত করে নিন।
ধরা যাক, আপনি রুম পরিস্কার করতে চাচ্ছেন। কাজটা নিঃসন্দেহে বোরিং একটি কাজ, কারো কারো কাছে বিরক্তিকরও বটে। কিন্তু রুম পরিস্কার করার সময় যদি কানের হেডফোনে যদি নিজের পছন্দের গানগুলো শোনেন তাহলে তখন আর কাজটা ততটা বিরক্তিকর মনে হবে না।
এভাবে বিভিন্ন কাজে, পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে নিজেকে পুরস্কৃত করুন।
“You can make hard habits more attractive if you can learn to associate them with a positive experience.”
প্রতিদিন ভাল অভ্যাস ধরে রাখার উপায়
উন্নতি হচ্ছে- এই অনুভূতিটা খুবই আনন্দদায়ক একটা বিষয়। ভাল অভ্যাস চর্চা করার সময় দিন গোনার জন্য ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখতে পারেন। এতে নিজের নিয়মিত হওয়া ও লেগে থাকার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাবেন।
কোনোদিন মিস হয়ে গেলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যতদ্রুত সম্ভব আবার ভাল অভ্যাসে ফেরত আসুন, রুটিন মানুন। সেই সাথে প্রতিজ্ঞা করুন যেন পুনরায় এই ভুল না হয়।
মনে রাখবেন, একবার ভুল হলে সেটা দূর্ঘটনা কিন্তু পুনরায় হলে তা বদঅভ্যাসের লক্ষণ।
“The seed of every habit is a single, tiny decision.”
খেয়াল রাখবেন, ভুল করে ফেললে দমে যাবেন না। পারফেক্ট করার আশায় নিজের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবেন। নইলে দেখা যাবে আপনার পক্ষে ভাল অভ্যাস তৈরি করাই সম্ভব হচ্ছে না। আপনি বদঅভ্যাস নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
এক্ষেত্রে নিম্নের রুলটা অনুসরণ করুন –
গোলডিলকস রুল/Goldilocks Rule
“মানুষ সবচেয়ে বেশি মোটিভেশন পায় যখন সে এমন কাজ করে যেটা তার বর্তমান সামর্থ্য বা দক্ষতার কাছাকাছি। যে কাজ খুব কঠিন নয়, আবার একদম সহজও নয়।”- এটাই গোলডিলকস রুলস। মূলত এধরনের কাজেই আমরা লম্বা সময় ধরে মনোযোগ ধরে রাখতে পারি।
সেজন্য সচেতনভাবে নিজের কাজের সাথে সম্পৃক্ত কাছাকাছি স্কিলের অন্যান্য কাজে আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে-
- কোন কাজগুলো আমার কাছে মজার কিন্তু অন্যের কাছে চাপের কাজ বলে মনে হয়?
- কোন কাজে ডুবে থাকলে আমার কাছে সময়ের হিসাব থাকে না?
- আমি ন্যাচারালি কী করতে পারেন? যা করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না?
নিজেকে দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি।
“Ultimately, it’s your commitment to the process that will determine your progress.”
উপসংহার
বদঅভ্যাস পরিবর্তন না করলে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। লেখক জেমস ক্লিয়ার তাঁর লেখা এটমিক হ্যাবিটস বইতে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করার উপায়গুলো সহজভাবে বাতলে দিয়েছেন। পাঠকদের সুবিধার্থে সেই উপায়গুলো এই আর্টিকেলে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।
উক্ত কৌশলগুলো চর্চা করলে আপনি নিজের খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে, ভাল অভ্যাস রপ্ত করার মাধ্যমে নিঃসন্দেহে একজন সফল ব্যক্তিতে পরিণত হবেন।
Author
মুরাদ খান (Murad Khan) এর ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আলাদা আগ্রহ আছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনে ভালো পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে ভালোবাসেন। । কর্মজীবন শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং দিয়ে, পরে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন। নিজের চেষ্টায় অর্জন করেছেন ডিজিটাল মার্কেটিং এর বিভিন্ন দক্ষতা। কাজ করছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী মানুষের জীবন মান উন্নয়নে। এই লক্ষ্যেই বিডি আইসিটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠা।